‘আমানি’ কাকে বলে ? পান্তা ভাতের সাথে এর কি কোনো যোগ রয়েছে?
সখী ‘আমানি’ কারে কয়!
অন্তরা চৌধুরি
আমানি…। কাব্যে এক উপেক্ষিত পানীয়। আগের পোস্টে তেলপোড়া নিয়ে লেখাটা আপনাদের খুব ভালো লেগেছিল। সেইজন্য সকলকে ধন্যবাদ। কিন্তু এই তেলপোড়ার প্রসঙ্গেই অনেকে জানতে চেয়েছেন আমানি কী জিনিস?
অধিকাংশ মানুষই আমানি সম্পর্কে জানেন।
যাঁরা জানেন না, আজকের এই লেখা তাঁদের উদ্দেশ্যে।
সহজ কথায় বলতে গেলে ভিজে ভাতের জলকেই ‘আমানি’ বলে। কিন্তু ভাতে জল ঢেলে দিলেই সেটা আমানি হয় না। ভালোভাবে আমানি করতে হলে একটু পরিশ্রম করতে হয়। আমরা দিনের বেলায় বা রাতের বেলায় যে গরম ভাত খাই, সেই ভাতের ফ্যান ঝরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু আমানি করতে গেলে সেই ফ্যান কিছুটা রেখে দিতে হবে। গরম ভাত খাওয়ার পর যে অবশিষ্ট ভাত বেঁচে যায় তাতে কিছুটা ফ্যান এবং কিছুটা জল, সঙ্গে একটু নুন দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিলেই হলো। অনেকে আবার এর সঙ্গে বিউলির ডাল রান্না করে সেই ডালের জলটাও দেয়। এতে টক ভাবটা একটু বেশি হয়। পরের দিন যখন সেই ভাতের ঢাকা খোলা হয়, তখন দেখা যায় যে ভাতের ওপরের জলটা বেশ সাদা ঘন হয়ে আছে। এই জলটাই আমানি।
বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার দিকে একটা কথা প্রচলিত আছে-
‘পান্তাভাতের জল/তিন পুরুষের বল’।
এই পান্তাভাতের জল বা আমানিকে নানাভাবে খাওয়া যায়। কেউ গ্লাসে ঢেলে এক চিমটে নুন দিয়ে খেয়ে নেন। কেউ আবার এই জলের সঙ্গে মিশিয়ে দেন পোস্ত বাটা। তখন সেই আমানির স্বাদ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কেউ আবার ভিজে ভাতের পাতে তেল লঙ্কা পেঁয়াজ সাথে মেখে খান। অনেকেই এই পান্তাভাতের সঙ্গে নেন সঙ্গে মেখে নেন মুড়ি। দুপুরবেলায় গরমভাতের সঙ্গে পঞ্চব্যঞ্জন খাওয়ার প্রথা আছে। তাই বলে পান্তাভাতকেও অবহেলা করার কোনও কারণ নেই। এবার যে যার অভিরুচি অনুযায়ী পদ তৈরি করে নেন।
যেমন চপমাখা। দোকান থেকে আলুর চপ কিনে এনে তার সঙ্গে পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা অথবা তেলপোড়া দিয়ে বেশ রসিয়ে মাখতে হয়। পান্তাভাতের চাট হিসেবে দুর্দান্ত।
কিন্তু যদি চপ না পাওয়া যায়? তাহলে পেঁয়াজ মাখলেই হলো। পেঁয়াজকে কুচি কুচি করে তাতে একটু নুন ও ভাজা তেল লঙ্কা দিয়ে মেখে নিলেই ব্যাস্!
ছাতুমাখা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। শুকনো ছাতুর সঙ্গে একটু আচার বা লেবুর রস, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখলে আর কিছুই লাগে না।
অনেকে মাছপোড়াকে লনাক পেঁয়াজ দিয়ে মেখে সেটাকেও ভিজে ভাতের সঙ্গে চাট হিসেবে খান।
ভিজে ভাতের সঙ্গে আলু পেঁয়াজ ভাজা, বা পেঁয়াজিও অনেকের অত্যন্ত প্রিয়। তবে এক এক জায়গায় মানুষের এক একরকম খাবার অভ্যেস। একের সঙ্গে অন্যের নাও মিলতে পারে। তবে আমি যেটা দেখেছি সেটাই লিখছি।
বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এইসব জায়গা অত্যন্ত রুক্ষ। গরম কালে এখানে ভয়ংকর ‘লু’ বয়। তাই যারা ক্ষেতে খামারে কাজ করেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই এই পান্তাভাত অত্যন্ত পছন্দ করেন। এই পান্তাভাত তাঁদের রক্ষাকবচ। কারণ এর অনেক গুণ। প্রথম কথা এই ভাত বিশেষতঃ আমানি খেলে রোদ লাগে না এবং লু এর হাত থেকে বাঁচা যায়। সানস্ট্রোক এবং ডিহাইড্রেশন হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। ডায়াবেটিসের রোগীরাও অল্প বিস্তর এই ভাত খেতে পারেন।
তবে এলিট সোশ্যাইটির মানুষরা অবশ্য এই সব প্রান্তিক খাবার খান না। তাতে তাঁদের স্ট্যাটাসে ভাঁটা পড়ে। তবে আমি ছোট থেকে এই সমস্ত খাবার খেয়েই বড় হয়েছি। এখনও অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে খাই।
তবে আমানি শুধু খেলেই হবে না। তাকে উপভোগ করতে হবে। দুপুর বা রাত্রিরের তুলনায় সকাল দশটা, এগারোটা নাগাদ খেলেই ভালো। খাওয়ার পর হাতে যদি তেমন কোনও কাজ না থাকে, তাহলে সুখস্বপ্ন দেখতে দেখতে আরামসে একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে। ঘুম থেকে উঠেও যদি নেশা নেশা লাগে, এবং চারদিকটা বেশ ফুরফুরে মনে হয় তবেই আমানি খাওয়ার সার্থকতা।
এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট গল্প বলি।
আমার কাকা কনট্রাকটর। তাঁর কাছে কাজের জন্য বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে প্রচুর সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষকে আসতে দেখেছি ছোটবেলা থেকেই। ওঁদের মধ্যে অনেকেই আমাদের আত্মীয়ের চেয়েও বেশি কাছের হয়ে উঠেছে। সে কারণেই সাঁওতালদের জীবনযাত্রা, ওদের সংস্কৃতি খুব নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। সে বিষয়ে পরে কোনও একদিন লেখা যাবে।
প্রায় বছর কুড়ি ধরে এক সাঁওতাল মহিলা আমার কাকার কাছে কাজ করে। থাকে শুশুনিয়ার কাছে একটা গ্রামে। বয়স দেখে আন্দাজ করা যায় না। দশ বছর আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে। যেদিন বাড়ি যেতে দেরি হয়ে যায় সেদিন আমাদের বাড়িতেই থেকে যায়। সে কাঠের উনুনে আলাদা রান্না করে। রাত্রিবেলায় যখন সবাই খেতে বসি তখন বুড়িও বসে আমাদের পেছন দিকে। দেখি একটা বড় থালায় কিছুটা ভাত, আর তার চেয়েও বেশি পরিমাণে সেই আমানি নিয়ে সে খেতে বসল। মাআদের তরকারি তার খুব একটা পছন্দ নয় বলে সে নিজেই নিজের মতো কিছু একটা করে নেয়। হয় আলুভাতে বা টমেটো পোড়া। বুড়ির ওই সাদা জল মাখা ভাত দেখে বড্ড লোভ লাগে। বুড়িকে বলি,
‘কাল বেশি করে ভাত করে আমাকে দিস। আমানি সহ’।
আমার মা চোখ পাকিয়ে কাছে এসে বিড়বিড় করে বলে,
‘তুই খেতে পাস না? ওর ভাতটা খেতে তোর রুচি হবে?’
‘রুচি না হবার কী আছে। ও তো মানুষ। স্নানটান সেরে কাচা কাপড় পরে ভাত রান্না করেছে। আমার খেতে অসুবিধেটা কোথায়?’
আসল কথা হল আমাদের বাড়িতে যে জলছাঁকা ভাত থাকে তার টেস্ট মোটেও হয় না। আমানির তো নয়ই। কারণ আমাদের বাড়িতে শুধু নয়; অধিকাংশ লোকের বাড়িতেই আজকাল সাদা ধব্ধবে বুদ্ধিজীবি চালের ভাত হয়। সেই চালের ভাত দেখতেই সুন্দর। কিন্তু স্বাদ নেই একটুও। গরম ভাতেরই যদি স্বাদ না থাকে তাহলে পান্তাভাতের স্বাদ হবে কোত্থেকে!
আমাদের বুড়ি লাল লাল গোল গোল মোটা মোটা চালের ভাত খায়। ওই মোটা চালের ভাত তিন বেলা খেয়েও সে কত স্লিম আছে। আর আমরা স্লিম চালের ভাত এক বেলা এক চতুর্থাংশ খেয়েও দিন দিন মোটা হচ্ছি। একেই বলে জীবনের ট্র্যাজেডি!
ওই চালের গরম ফ্যান ভাত খেলেও মনে হয় স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করা যাবে। পান্তাভাত হলে তো কথাই নেই।
কিন্তু জানেন আমার এখনও বুড়ির ওই ভাত খাওয়াই হয়নি।
তবে ঠিক করেছি এবারে বাঁকুড়া গেলেই খাব।
Antara Chowdhury র ওয়াল থেকে সংগৃহীত!
https://www.facebook.com/groups/aharebangali/permalink/961180135022584/?mibextid=Nif5oz
***
Comments
Post a Comment